ফুটবল খেলোয়াড়
একাত্তরে সিলেটের মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র ছিলেন শ্রীকান্ত দাস। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের পর পরিস্থিতি বদলে যায়। শহর হয়ে পড়ে জনশূন্য। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীরাও ছাত্রাবাস ছাড়েন। অন্য অনেকের মতো শ্রীকান্তও বাড়ি ফেরেন।......।।
আরও পড়ুন
‘আমার কিছু হবে না’ বলে বেরিয়ে গিয়েছিলেন বাবা
‘আমার কিছু হবে না’ বলে বেরিয়ে গিয়েছিলেন বাবা
হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলার বদলপুর ইউনিয়নের পাহাড়পুর গ্রামে শ্রীকান্তের বাড়ি। ১৯৫২ সালে হাওরের এই প্রত্যন্ত গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে তাঁর জন্ম। বাবা নীলকান্ত দাস ও মা চন্দ্রময়ী দাসের চার সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। গ্রামের বিদ্যালয়ে প্রাথমিক পর্যন্ত পড়েন। এরপর ১৯৬৯ সালে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী হিসেবে বিরাট এএবিসি হাইস্কুল থেকে প্রথম শ্রেণিতে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। এরপরই ভর্তি হন এমসি কলেজে।
বাড়ি ফিরে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির দিকে নজর রাখেন শ্রীকান্ত। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি নেন। গ্রামের আরও কয়েকজনকে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য উৎসাহ দেন। পরে শ্রীকান্ত ১৭ মে গোপাল চক্রবর্তী, হরিপ্রসন্ন চক্রবর্তী ও সুশান্ত দাসকে নিয়ে ভারতের মেঘালয়ে চলে যান। ২৮ দিনের প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে তাঁরা ৫ নম্বর সেক্টরে যোগ দেন। প্রশিক্ষণকালে শ্রীকান্তের ব্যাচ নম্বর ছিল ৬।
বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনে অংশ নেন শ্রীকান্ত দাস। ১৯৭১ সালের ২৭ নভেম্বর সুনামগঞ্জের বৈশেরপাড়া ষোলগড় ডলুরা এলাকায় সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হন তিনি। বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে তাঁর হৃৎপিণ্ড ও চোখ তুলে নেয় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। রাস্তায় পড়ে ছিল তাঁর লাশ। পরে ডলুরা গণকবরে তাঁকে সমাহিত করা হয়। এই গণকবরের ৪৪ নম্বর স্মৃতিস্মারকটি হচ্ছে শ্রীকান্ত দাসের।
মুক্তিযুদ্ধ শেষে ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। এমসি কলেজ ছাত্রাবাসেও ফিরতে শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। ১৯৭২ সালের শেষ দিকে শ্রীকান্তের স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতে শিক্ষার্থীরা ‘শহীদ শ্রীকান্ত ছাত্রাবাস’ সাইনবোর্ড ছাত্রাবাসের ব্লকে সাঁটিয়ে দেন।
সে সময় ছাত্রাবাসের বাসিন্দা ছিলেন রসায়ন বিভাগের স্নাতকের শিক্ষার্থী তমাল কুমার বিশ্বাস। এখন তিনি হবিগঞ্জে আইনপেশায় যুক্ত। সত্তরোর্ধ্ব তমাল জানান, শহীদ শ্রীকান্তের স্মৃতি রক্ষায় কলেজ প্রশাসনকে অনুরোধ করলে তাঁরা গুরুত্ব দেননি। ছাত্ররা সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেওয়ার পর অবশ্য কলেজ কর্তৃপক্ষও কাগজপত্রে শহীদ শ্রীকান্ত ছাত্রাবাস নামটি বহাল রাখে।
একটি সাইনবোর্ড ছাড়া ছাত্রাবাসটিতে আর কিছুই পাওয়া যায়নি। নেই কোনো ছবি বা স্মৃতিচিহ্ন। এ নিয়ে আবাসিক শিক্ষার্থীদের আক্ষেপও আছে। এ বিষয়ে শহীদ শ্রীকান্ত ছাত্রাবাসের বর্তমান হোস্টেল সুপার জীবনকৃষ্ণ আচার্য জানান, নামকরণটুকু ছাড়া শহীদ শ্রীকান্তের কোনো স্মৃতিচিহ্ন ছাত্রাবাসে নেই।
শহীদ শ্রীকান্তের গ্রামের বাড়িতে ১১ ডিসেম্বর রাতে খোঁজ নেওয়া হয়। শ্রীকান্তের বড় ভাই রতিকান্ত দাসের ছেলে সুজিত কুমার দাস (৫১) জানান, তাঁর বাবারা ছিলেন তিন ভাই। শ্রীকান্ত ছিলেন মেজ। শ্রীকান্তের বড় ভাই রতিকান্ত ২০০৯ সালে মারা যান। তবে শ্রীকান্তের ছোট ভাই উমাকান্ত দাস (৭০) জীবিত। এ ছাড়া ময়তারা দাস (৬০) নামে শ্রীকান্তের এক ছোট বোন আছেন।
সুজিত বলেন, তিনি ও তাঁর চাচা উমাকান্ত কৃষিজীবী। একেবারেই অসচ্ছল পরিবারের মানুষ তাঁরা। তবে এ নিয়ে তাঁদের কোনো আক্ষেপ নেই। আক্ষেপ কেবল এই, শহীদ পরিবার হিসেবে তাঁরা কোনো ভাতা পাওয়া তো দূরের কথা, মর্যাদাটুকুও পাচ্ছেন না। শহীদ শ্রীকান্তের স্মৃতি রক্ষায়ও তেমন কোনো উদ্যোগ নেই।